শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৭ পূর্বাহ্ন
মোঃ হাবিবুর রহমানঃ
একটা স্বশিক্ষিত ও উন্নত জাতি গঠনে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম অপরদিকে দেশকে উন্নত এবং তথ্য প্রযুক্তি সম্পন্ন রাষ্ট্রে পরিণত করতে শিক্ষার গুরুত্বও কোন অংশে কম নয়। শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে। একজন শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক,, নান্দনিক, আধ্যাত্মিক ও আবেগিক বিকাশ সাধন ঘটে প্রাথমিক স্তরে এছাড়াও শিশুদের দেশাত্ববোধ, বিজ্ঞানমনস্ক এমনকি সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে। শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন কারিকুলাম প্রকাশের পর থেকেই শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে চলছে আলোচনা সমালোচনা ।বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষা সংশ্লিস্ট ব্যক্তিবর্গ পক্ষে বিপক্ষে, ভালো-মন্দের দিক নিয়ে আলোচনা করছেন। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ে এমনকি বিদেশ থেকেও ধার করা বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে আমাদের দেশে প্রয়োগ করার চেষ্টাও করা হয়েছে বারংবার। সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০ এর পূর্বে ৬ টি শিক্ষা কমিশন কাজ করেছে কিন্তু কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে শিক্ষা ব্যবস্থায় সকল বিষয় কার্যকর করা হয়নি বা অনেক কমিশনের রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। বারবার শিক্ষা পদ্ধতিতে রদবদল করেও সঠিক মান অর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই মনে হয়। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষা কারিকুলামের পরিবর্তনও যেমন দরকার তেমনি ঘনঘন পরিবর্তনও কাম্য নয়। এতে শিক্ষা ব্যবস্থায় আঘাত আসে এমনকি বিশৃংখলা দেখা যায়। নতুন কারিকুলাম বাস্তবে প্রয়োগের আগে শিক্ষার্থীদের অধিক যাচাই করার প্রয়োজন ছিল যা পর্যাপ্ত পরিমাণ করা হয়নি বলে মনে হয়। শুধু নতুন কারিকুলাম তৈরি করে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগ করলেই হবে না পাশাপাশি শিক্ষার সাথে সংশ্লিস্ট সকল ব্যবস্থার পরিবর্তন অথবা সংযোজন করতে হবে।
প্রথমত ২০২৩ সাল থেকে নতুন কারিকুলাম অনুসারে সকল স্তরে শ্রেণী কার্য়ক্রম শুরু হবে আমরা সবাই অবগত। দীর্ঘদিনের অভ্যস্ত একটা কারিকুলাম থেকে বের হয়ে নতুনভাবে নতুন কারিকুলাম সম্পর্কে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক প্রচারণার ব্যবস্থা করা। প্রাথমিক পর্যায়ের সকল শিক্ষককে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ অথবা অবগত করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। শিক্ষকদের দক্ষ ও উপযুক্ত করে গড়ে ত্লোা, শিখন শেখানো কৌশলগুলোকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য প্রশিক্ষণ অপরিহার্য্। এছাড়াও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের অধীন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাধীন মাঠ পর্যায়ে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মনিটরিং এর জন্য নিয়োগকৃত কর্মকর্তাদেরও এ বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরী।
দ্বিতীয়ত গুনগত শিক্ষার জন্য যে উপাদানটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে মানসম্পন্ন শিক্ষক। দেশে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ৩৪ হাজার ১৪৭ । এর মধ্যে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৩ হাজার ৬০১ টি। প্রাথমিক শিক্ষায় সর্বমোট ৩ লাখ ২২ হাজার ১৪৭ জন শিক্ষক নিযোজিত আছেন। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনে শিক্ষক শিক্ষার্থী অনুপাত হওয়া দরকার ১ : ৩০। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই আনুপাতিক হার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে বিভিন্ন রকম। শিক্ষক শিক্ষার্থী অনুপাত ঠিক রাখতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। মন্ত্রনালয়ে এ বছর প্রায় ৩২ হাজারেরও বেশি শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন আছে। মান সম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরনে ভালো শিক্ষাগত যোগ্যতার অধিকারী মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। সব শিক্ষকের জন্য বুনিয়াদি ও বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, কর্মরত শিক্ষকদের জন্য কর্মকালীন প্রশিক্ষণ এবং পাঁচবছর অন্তর সন্জীবনী কোর্সের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং একই সঙ্গে শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করতে অবশ্যই যথোপযুক্ত বেতনভাতা দিয়ে মেীলিক অধিকারের নিশ্চয়তা ও পেশাগত স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে।
তৃতীয়ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করতে হবে। যদিও বিগত কয়েক বছর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মপরিকল্পনা অনুসারে সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিদ্যালয়ের অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে। নতুন ভবনের পাশাপাশি স্যানিটাইজেশনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। বিশুদ্ধ খাবার পানির ও ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থী অনুপাতে নতুন ভবন নির্মানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে এবং এই উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হবে।
চতুর্থত মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করণে, বিজ্ঞান মনস্ক ও তথ্য প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন হতে হলে যুগোপযোগী ধ্যান ধারনার আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেই লক্ষ্যে সরকার সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর দিয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় মাল্টিমিডিয়া তথা ডিজিটাল ক্লাসরুমের ব্যবহারের সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য রয়েছে। বিশ্বায়নের যুগে উন্নত দেশের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও শিক্ষার গুনগতমান নিশ্চিতকরণে শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানো এবং শ্রেণী কার্যক্রমে অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের মতো প্রযুক্তিকেও একটি শিক্ষা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা, যা শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন মেটাতে সহায়তা করবে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম তৈরির লক্ষ্যে প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, মডেম, সাউন্ড সিস্টেম বিতরণ করা হয়েছে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা লাভ এবং তা আয়ত্ব ও প্রয়োগ করা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। জাতিসংঘ গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) সকলের জন্য টেকসই গুনগত মানসম্পন্ন শিক্ষার ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ডিজিটাল ক্লাসরুম ব্যবহার করে সেই কাঙ্খিত মান অর্জন করা সম্ভব। শিশুদের শিক্ষার পরিবেশ, পাঠদান পদ্ধতি ও বিষয়বস্তু আকর্ষণীয় ও আনন্দময় করে তোলা অতি জরুরী । মুখস্ত বিদ্যার পরিবর্তে বিকশিত চিন্তাশক্তি, কল্পনাশক্তি এবং অনুসন্দিৎসু মননের অধিকারী হয়ে সকল শিক্ষার্থী যাতে প্রতি স্তরে মানসম্পন্ন প্রন্তিক যোগ্যতা অর্জন করতে পারে তা নিশ্চিত করতে ডিজিটাল শিক্ষা কন্টেন্টের ব্যবহার অত্যাবশ্যক। যেসকল শিক্ষক মন্ডলী ডিজিটাল কন্টেন্ট ব্যবহার করে শ্রেণী পাঠদান পরিচালনা করবেন তাদের সকলকে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রশিক্ষণ দেয়া এবং প্রশিক্ষণ পরবর্তী মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে পারলেই শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রযুক্তি ভীতি দূর হয়ে তথ্য প্রযুক্তিতে পারংগমতা নিশ্চিত এবং দেশজ আবহ ও উপাদান সম্পৃক্ততার মাধ্যমে শিক্ষাকে শিক্ষার্থীর চিন্তা চেতনা ও সৃজনশীলতার উজ্জীবন এবং তার জীবন ঘনিষ্ঠ জ্ঞান বিকাশে সহায়ক হবে।
সর্বোপরি জাতিসংঘ গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) এর ৪ নং অভিষ্ঠ ”সকলের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুনগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষালাভের সুযোগ সৃষ্টি । যার ৪.২ নং লক্ষ্য মাত্রা ২০৩০ সালের মধ্যে সকল ছেলে মেয়ে যাতে প্রাথমিক শিক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাসহ শৈশবের একেবারে গোড়া থেকে মানসম্মত বিকাশ ও পরিচর্যার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে তার নিশ্চয়তা বিধান করা”। এই অভিষ্ঠ্যগুলো বাস্তবায়নে প্রাথমিক স্তরের সকল পর্যায়ে যে ধরণের প্রতিবন্ধকতা আছে সেগুলোকে দূরীকরণের মাধ্যমে একটা প্রযুক্তি নির্ভর দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা সম্ভব।
এছাড়াও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করণে লেখাপড়ার পাশাপাশি শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা উন্নতির জন্য সারাদেশব্যপী চালু করা হয়েছে স্কুল ফিডিং প্রকল্প ও মিড ডে মিল কার্যক্রম চালু হয়েছে, যার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য সহশিক্ষা কার্যক্রমের নতুন সংযোজন ‘বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট’ এবং ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট’, কাবিং , হলদে পাখি, ক্ষুদে ডাক্তার , স্টুডেন্ট কাউন্সিল গঠন, আন্তঃ প্রাথমিক বিদ্যালয় ক্রীড় ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ,জাতীয় শিশু প্রতিযোগিতা। বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততায় এই সকল কার্যক্রম গুলো সুষ্ঠ ও সুন্দরভাবে আয়োজন নিশ্চিত করতে হবে।
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। শিশুরাই একদিন শিক্ষিত ও প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ মানবসম্পদ হয়ে দেশের হাল ধরবে এবং সার্বিক উন্নয়নে কাজ করবে। উন্নত রাষ্ট্র হওয়ার লক্ষ্যে সরকারের যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা তা বাস্তবায়নে বর্তমান প্রজন্মকে এখন থেকেই প্রস্তুত করতে হবে এবং সে প্রস্তুতির সূচনা হবে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে।
লেখকঃ মোঃ হাবিবুর রহমান, সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, কুষ্টিয়া সদর, কুষ্টিয়া।